আদর্শ মানুষের কাজই হচ্ছে মানুষের কল্যাণে কাজ করা। যে মানুষের দ্বারা অন্য মানুষের কল্যাণ হয় না, যার দ্বারা সমাজও উপকৃত হয় না তার জীবন অর্থহীন। সমাজে যে মানুষগুলো মানুষের কথা ভাবেন, মানুষের জন্য কাজ করেন, মানুষের আপদে-বিপদে পাশে দাঁড়ান তাঁরাই প্রকৃতপক্ষে ভালো মানুষ হিসেবে আমাদের কাছে পরিচিত। এমন মানুষের ত্যাগ ও অবদান চির অম্লান এবং মৃত্যুর পরেও এরা মানুষের মাঝে বেঁচে থাকেন। এসব মানুষের জন্য সমাজের প্রতিটা মানুষের মনে জন্মে নিখুঁত ভালোবাসা। মনে-প্রাণে এসব মানুষদেরকে মানুষ শ্রদ্ধা করে।
এমন ভালো মানুষের সংখ্যা আমাদের সমাজে কোনো কালেই তেমন বেশি ছিলো না। খুব অল্পসংখ্যক মানুষই নিজে আলোকিত হয়ে সমাজকে আলোকিত করতে পারেন। চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়া উপজেলার তেমনি একজন শিক্ষাবিদ, শিক্ষানুরাগী এবং একনিষ্ঠ সমাজসেবক অধ্যক্ষ ড. রেজাউল কবির। তিনি মানুষের সেবায় দীর্ঘদিন কাজ করলেও মানুষ তাঁকে ঐভাবে চিনতে পারেনি। অথচ তাঁর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কারণেই এই উপজেলার শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছে। নব্বুইয়ের দশকে লোহাগাড়া উপজেলার এটিই প্রথম প্রতিষ্ঠিত কলেজ। যেখানে সুদূর কক্সবাজার থেকেও শিক্ষার্থীরা পড়তে আসতো। এই প্রচারের যুগে যেখানে অনেক প্রচারমুখী মানুষ অল্প কাজ করে বেশি প্রচারে মত্ত, সেখানে ড. রেজাউল কবির নিজেকে আড়ালে রেখে এই অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন এবং এখনো তা বিদ্যমান আছে।
ব্যক্তিগত জীবনঃ
ড. রেজাউল কবির ১লা জুন ১৯৫১ সালে বর্তমান লোহাগাড়া উপজেলার (তৎকালীন অবিভক্ত সাতকানিয়া উপজেলা) আমিরাবাদ ইউনিয়নের এক মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম আহমদ কবির এবং মাতা মরহুমা মিসেস হুসনে আরা জান্নাত। মা-বাবার দেওয়া পারিবারিক শিক্ষাকে ধারণ করে তিনি জীবনকে সুন্দর ও সমৃদ্ধি করার প্রয়াস চালিয়ে যান। নির্লোভ এই জ্ঞানগর্ভ মানুষটি ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে এলাকার মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার তাগিদে একজন দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন উদ্যোগী হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। যাঁর জ্ঞান ও মেধার কোন অপরিপূর্ণতা ছিলো না। তিনি নিজে একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে জ্ঞানদান করেই থেমে থাকেননি। এলাকার মানুষদের উচ্চ শিক্ষার্জনের সুযোগ করে দেওয়ার উদ্যোগও সর্বপ্রথম তিনিই নিয়েছিলেন।
শিক্ষা জীবনঃ মা-বাবার কাছেই তাঁর শিশুশিক্ষার হাতেখড়ি। তিনি গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাঁর প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। তিনি ১৯৬৬ সালে দক্ষিণ সাতকানিয়া গোলামবারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে মাধ্যমিক এবং ১৯৬৯ সালে সাতকানিয়া কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য তিনি চট্টগ্রাম শহরে চলে যান। পিতা-মাতার দেওয়া পারিবারিক শিক্ষা তাঁর জীবনে চলার পথে পাথেয় হয়ে রয়। তাই তাঁর পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া এই আদর্শিক মূল্যবোধ তাঁর শিক্ষা জীবনেও প্রভাব ফেলে। উপযুক্ত পিতামাতার আদর্শবান সন্তান ড. রেজাউল কবির শিক্ষা জীবনে সফল হয়েছেন। ফলে তার ছাত্রজীবন আরো গতিশীল হতে থাকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতক(সম্মান) এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে কৃতিত্বের সাথে তাঁর দ্বিতীয় স্নাতকোত্তর ডিগ্রী সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি আরো উচ্চতর শিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি পিএইচডি ডিগ্রী লাভের মাধ্যমে জীবনে এক অনন্য সফলতা নিয়ে আসেন।
কর্ম জীবনঃ উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করে তিনি দেশে ফেরেন। তখন তিনি শিক্ষা জীবন শেষ করেন। এরপর তিনি শিক্ষকতার মহান পেশাকে তাঁর চূড়ান্ত পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। চট্টগ্রামের পটিয়া হুলাইন সালেহ নূর কলেজে তিনি অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৯৭৬-১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তিনি অত্র কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি তার জীবনের বেশিরভাগ সময়েই চট্টগ্রামে কাটিয়েছেন। বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাওয়া হয়েছিলো। এরপর থেকে এই অঞ্চলেই তিনি বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ সালে তিনি নিজ জেলার বাঁশখালি আলাউল কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এখানে তিনি দীর্ঘ ৮ বছর কর্মরত ছিলেন। ১৯৮৭ সালে তিনি কক্সবাজার জেলার চকরিয়া কলেজে বদলি হয়ে সেখানে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পান। এখানে তিন বছর চাকুরি করার পর ১৯৯০ সালে বদলি হন চট্টগ্রাম শহরের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে। উক্ত কলেজে তিনি ১৯৯০ সাল থেকে অধ্যাপনা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি কর্মরত ছিলেন।
সামাজিক জীবনঃ
ড. রেজাউল কবির সারাজীবন সমাজের মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। সমাজ উন্নয়নে এই ব্যক্তির ভূমিকা অপরিসীম। যিনি দেশের বিভিন্ন সংগঠনের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখে সমাজ তথা রাষ্ট্রের সেবা করে গেছেন।
👉 ড. রেজাউল কবির চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এর একজন সিনেট সদস্য।
👉 তিনি ১৯৮০ সালে লোহাগাড়া উপজেলায় বার আউলিয়া ডিগ্রী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নিজ বাড়ি সংলগ্ন প্রতিষ্ঠা করেন আমিরাবাদ জয়নাব-কবির একাডেমি। যেটা সরকার অনুমোদিত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পরবর্তীতে এই স্কুল সরকারি হওয়ার পর নাম পরিবর্তন হয়। যার বর্তমান নাম জয়নাব-কবির সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এর পাশে একটি দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। জয়নাব-কবির একাডেমির মাধ্যমে তাঁর একটি সূদুর প্রসারী কর্মপরিকল্পনা আছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালে এই বিদ্যায়লয়ের পাশেই ড. রেজাউল কবির তাঁর নিজের নামে একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
👉 তিনি এন্ট্রিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন, ঢাকা; রীমা ডিগ্রী কলেজ, চট্টগ্রাম; চট্টগ্রাম সাউদার্ন লাইন্স ক্লাবসহ বেশ কয়েকটি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
👉 তিনি চট্টগ্রাম সমিতি, ঢাকা; মা ও শিশু হাসপাতাল, চট্টগ্রাম; ডায়াবেটিক সমিতি, চট্টগ্রামসহ কয়েকটি সংগঠনের আজীবন সদস্য
👉তিনি বার আউলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সভাপতি, চট্টগ্রাম ল্যাবরেটরি কলেজ এর সভাপতি, আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশন এর সহ-সভাপতি, আল হেকমাহ এডুকেশন সেন্টার, চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজ এর সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
👉 তিনি শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ হিসেবে একজন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। ১৯৮৮ সালে তখন তিনি কক্সবাজার জেলার চকরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন।
আগামী পহেলা জুন ২০২০ তারিখে শিক্ষানুরাগী, কর্মবীর ড. রেজাউল কবির ৭০ বছরে পা রাখবেন। এই মানুষটির সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।